উদ্বেগজনক শিক্ষিত বেকার: ২৮ লাখ কর্মক্ষম বেকার, ৪.৫ লাখ সরকারি পদ শূন্য
দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিন দিন alarming হারে বাড়ছে। গত ১০ বছরে উচ্চশিক্ষিত বেকার বেড়েছে প্রায় ২৪.৫ শতাংশ। প্রতি বছর উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী পাশ করে বের হলেও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে না সেই তুলনায়। বর্তমানে শ্রমবাজারে প্রায় ২৬ থেকে ২৮ লাখ কর্মক্ষম বেকার রয়েছেন।
অন্যদিকে, সরকারি প্রতিষ্ঠানে সাড়ে চার লাখের বেশি পদ শূন্য থাকলেও, সেগুলোর পূরণে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) তথ্য বলছে, বর্তমানে মোট ৪,৬৮,২২০টি সরকারি পদ ফাঁকা রয়েছে। এর মধ্যে প্রথম থেকে ৯ম গ্রেডে ৬৮,৮৮৪টি, ১০ম থেকে ১২তম গ্রেডে ১,২৮,৫৬৩টি, এবং তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পদে প্রায় ২.৫ লক্ষাধিক পদ শূন্য।
শিক্ষাব্যবস্থা ও কর্মসংস্থানের মধ্যে সমন্বয়হীনতা
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা কর্মমুখী নয়, যার ফলে শিক্ষার সঙ্গে কর্মের কোনো সংযোগ স্থাপন করা যাচ্ছে না। চাকরির বাজারের চাহিদা ও যোগানের মধ্যে বড় ধরনের gap রয়েছে। শিক্ষাবিদরা বলছেন, যে ধরনের জনবল চাকরির বাজারে প্রয়োজন, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা তা তৈরি করতে পারছে না।
শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন: দেশে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়লেও শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, যা দেশের উচ্চশিক্ষার প্রায় ৭০% শিক্ষার্থীর ভার বহন করে, তাদের উপাচার্য অধ্যাপক এসএম আমানুল্লাহর মতে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম ও শিল্প খাতের মধ্যে কোনো সংযোগ নেই। গবেষণায় দেখা গেছে, এখান থেকে পাশ করা ২৮.২৪% শিক্ষার্থীই বেকার থেকে যান।
কারিগরি শিক্ষার অভাব: উন্নত দেশগুলোতে ৭০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী কারিগরি শিক্ষায় পড়লেও, বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী এই হার মাত্র ৯ শতাংশ। শিক্ষাবিদরা কারিগরি শিক্ষাকে আধুনিকীকরণ করে এর হার অন্তত ৬০ শতাংশে উন্নীত করার তাগিদ দিয়েছেন, যেন শিক্ষার্থীরা কর্মমুখী শিক্ষা পেয়ে দক্ষ জনবলে পরিণত হতে পারে।
বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশে বেকারের সংখ্যা বেড়ে ২৭ লাখে পৌঁছেছে, যা ২০২৩ সালে ছিল ২৫.৫ লাখ। বিবিএসের শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২ অনুসারে, স্নাতক ডিগ্রিধারী বেকারের সংখ্যা প্রায় ৮ লাখ, যা ২০১৭ সালের তুলনায় দ্বিগুণ।
অর্থনীতিবিদদের অভিমত, দেশে বিনিয়োগ না বাড়লে এই সংকট দীর্ঘস্থায়ী হবে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে জিডিপি ৬-৭% বাড়লেও কর্মসংস্থান বেড়েছে মাত্র ২.২%।
সরকারের পদক্ষেপ ও বিশেষজ্ঞদের প্রত্যাশা
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান জানান, সরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং শূন্য পদগুলো পর্যায়ক্রমে পূরণ করা হচ্ছে। তবে সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া মনে করেন, এই সনদধারী বেকার সৃষ্টির দায় রাজনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকরা এড়াতে পারেন না এবং সরকারের কাছে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো কর্মপরিকল্পনা নেই।
বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিষয়ে সরকারের কাছে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য বা পরিকল্পনা নেই। প্রতি বছর ২০-২৪ লাখ নতুন কর্মক্ষম মানুষ চাকরির বাজারে প্রবেশ করলেও, তাদের জন্য নতুন চাকরির সুযোগ তৈরি, প্রশিক্ষণ এবং আত্মকর্মসংস্থানের জন্য ঋণের মতো বিষয়ে কোনো ডেটাবেজ বা সুসংগঠিত পরিকল্পনা নেই।
শিক্ষিত তরুণ-তরুণীর এই বিশাল অংশ বেকার থেকে যাওয়ায় তারা পরিবার ও রাষ্ট্রের বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন এবং চরম হতাশা ও মানসিক চাপে ভুগছেন। বিশেষজ্ঞরা দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, যেন দেশের প্রায় ৪৩ শতাংশ তরুণ জনগোষ্ঠী বোঝা না হয়ে সম্পদে পরিণত হতে পারে। অন্যথায়, এর ফলে সামাজিক অপরাধ, মাদকাসক্তি এবং পারিবারিক অস্থিরতা বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে।